আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): কয়েক মাস আগে গাজার বাসিন্দা আহমেদ শেহাদা এক অচেনা ব্যক্তির ফোন পান। তিনি দাবি করেন, একটি মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে কাজ করেন এবং শেহাদার পরিবারকে গাজা থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে পারবেন।
প্রথমে শেহাদা এটিকে প্রতারণা ভেবে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে এক বন্ধুর কাছ থেকে নিশ্চিত হন, সেও একই দলের সহায়তায় গাজা ছাড়তে পেরেছে। এরপর শেহাদাও ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
টাকা পাঠানোর পর শুরু হয় ভয় ও অনিশ্চয়তায় ভরা যাত্রা। শেহাদা, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে দুটি পৃথক বাসে করে ২৪ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিতে হয়। পুরো যাত্রায় ছিল ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হামলার আতঙ্ক। সেই ভীতিকর বাস ভ্রমণ শেষে তারা ইসরাইলি চেকপোস্ট পার হয়ে অজানা গন্তব্যের বিমান ধরেন। বহু জায়গা ঘুরে অবশেষে তারা পৌঁছান দক্ষিণ আফ্রিকায়; একটি দেশ যেখানে তারা কখনো যাননি।
শেহাদা বলেন, ‘গাজায় পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ যে, মানুষ বাধ্য হয় এই ঝুঁকি নিতে।’
দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার জানায়, এসব ফিলিস্তিনিকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বা নেপথ্যের সংগঠন সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। বিষয়টি তারা সন্দেহজনক বলেই মনে করছে।
চিকিৎসক শেহাদা তার পরিবারসহ ২৮ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছান। সম্প্রতি আরও কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে নিয়ে দুটি ফ্লাইট সেখানে অবতরণ করেছে।ফিলিস্তিনিদের পরিবহনের এই ব্যবস্থাটি করেছে আল-মাজদ ইউরোপ নামের একটি অপরিচিত সংগঠন। দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষ তাদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্যই জানে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেন, তাদের ধারণা, এর পেছনে ইসরাইলের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তিনি একে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে ইসরাইল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, তাদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো তার সরকারের দায়িত্ব, কারণ দেশটি দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তৃতীয় এক দেশের উদ্যোগে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে পাঠানোর অনুমোদন তারা দিয়েছে; তবে সেই দেশটির নাম প্রকাশ করা হয়নি।
জি-২০ সম্মেলন সামনে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই এ ধরনের রহস্যময় ফ্লাইট দেশটিতে অবতরণ করে। দ্বিতীয় ফ্লাইট অবতরণের সময় ১৫৩ ফিলিস্তিনিকে প্রায় ১০ ঘণ্টা বিমানের ভেতরে অপেক্ষায় রাখতে হয় প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায়, যা নিয়ে সমালোচনা চলছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজকর্মী নাঈম জিনাহ জানান, গাজা থেকে আসা এসব মানুষ যে মানবিক সংকটের ভেতর দিয়ে এসেছে, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনাতেই নিতে চাইছিল না।
শেহাদাদের অবস্থা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। জাতিসংঘের একটি সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে তারা ২৮ অক্টোবর স্বাভাবিকভাবেই ইমিগ্রেশন পার হতে পেরেছেন।
গাজা যুদ্ধের সময় শেহাদার পরিবারকে ১২ বার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। মার্চে আল-মাজদের ওয়েবসাইট দেখে তিনি যোগাযোগ করেন। আবেদন জমা দেওয়ার এক মাস পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। যুদ্ধ তীব্র হলে শেহাদা মোট ৬ হাজার ৪০০ ডলার পাঠান। ২৬ অক্টোবর রাতে হঠাৎ তাদের খান ইউনিসে পৌঁছানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেখানে তাদের একটি বাসে ওঠানো হয় এবং জানানো হয়, রাফায় যাওয়ার পথে পর্দা না সরাতে ও ফোন বন্ধ রাখতে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ফরাসি দূতাবাসের সরিয়ে নেওয়ার কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরিচয় দিতে বলা হয়।
সবশেষে কেরেম শালোম সীমান্ত হয়ে কঠোর নিরাপত্তা চেক পার করে তাদের দক্ষিণ ইসরাইলের রামন বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। সেখানে ওঠানো হয় এক চার্টার্ড ফ্লাইটে। মাঝআকাশে গিয়েই তারা জানতে পারেন, প্রথম গন্তব্য কেনিয়ার নাইরোবি। এরপর সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানো।
দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে আল-মাজদ ইউরোপ তাদের একটি গেস্টহাউসের ঠিকানা পাঠায়, যদিও প্রতিশ্রুত এক মাসের বদলে দেওয়া হয় মাত্র এক সপ্তাহের থাকার ব্যবস্থা।
ওয়েবসাইটে এখনও বলা হচ্ছে, তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। তবে কোনো যোগাযোগের জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
সাইফ নামের আরেক ফিলিস্তিনি বলেন, তাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও আগে কিছু জানানো হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছার পর স্থানীয় একটি ত্রাণ সংস্থা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য ৯০ দিনের বিশেষ ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করে।
শেহাদা বলেন, তার চার বছরের মেয়ে জীবনে শুধু যুদ্ধই দেখেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে দোকানে খাবার কেনা বা ফোনে চার্জ দেওয়ার মতো স্বাভাবিক জিনিস দেখে সে বিস্মিত হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে রোজ আমাকে বলে, বাবা, আমরা যেন ইউটিউবের ভেতরের জীবনে এসে পড়েছি।’
Your Comment